আমার বাবা আমাকে এতো ভোরে কোনদিন ডাকেনি।কিন্তু আজ প্রথম ভোর ছয়টার দিকে বাবা আমাকে ডেকে বললেন, তোর কাছে কিছু টাকা হবে মা?
বাবার কথায় আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম।যে বাবা আমার পার্সোনাল খরচ দেয় সেই বাবা আবার উল্টো আমার কাছে টাকা চাইলো।
খুব কান্না পাচ্ছিলো তখন।প্রাইভেেসি চাইছিলাম একটু। কান্না চেপে বাবাকে বললাম,বাবা তুমি এখানে বস আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।
আসলে দেশ লকডাউন হওয়ার পর থেকে বাবা সংসার সামলাবে কি করে এনিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন।পুরো দেশে অফিস আদালত বন্ধ।কোন কোম্পানি বেতন দিয়েছেনতো আর কোন কোম্পানি দেননি।বাবা চাকরিও করেন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে।বেতন বিশ হাজার টাকা।যা দিয়ে আমাদের বাবা-মা সহ ভাইবোন পাঁচ জনের সংসারটা মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই চলে।এপ্রিলের চার তারিখে বাবার বেতন পাওয়ার কথা ছিলো।তার আগে অফিস বন্ধ হয়ে গেলো।আর কোম্পানিও মাস শেষ হয়নি বলে বেতনটাও দেয়নি।দেশের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে আতংকিত অবস্থায় বাবা ঘর থেকে যাতে বের হতে নাহয় যে অল্প টাকা ঘরে ছিলো তা দিয়ে অল্প চাল এবং ডাল নিয়ে এসেছিলেন।তা সব দশদিনের আগেই শেষ হয়ে গেলো।
মা কাল থেকে বারবার বলে আসছিলেন,লজ্জা ফেলে কি হবে বল, ছেলেমেয়ে তিনটাকে কি না খাইয়ে মারবে?যে অল্প তরকারি ফ্রিজে আছে তাতো কাল নাহয় পরশু শেষ হয়ে যাবে।তারপর কি হবে?তোমার বন্ধুদের কারো কাছ থেকে কিছু ধার-দেনা পাও কিনা চেষ্টা করে দেখো।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, কে দিবে বলো?ওরাও তো আমার মতোই। তবে দুয়েকজনের আমার চেয়ে একটু বেশি বাইশ-পচিশ হাজার।
মা তাও চেষ্টা করতে বলেছিল।বাবা তার যে বন্ধুর কাছে ফোন দিতে চাইলো সেই আগে ফোন দিয়ে বসলো।বাবা একটা দুঃখের ব্যাঙ্গাত্বক হাসি দিয়ে বললেন, কার কাছে ফোন করেছিস ভাই,আমিওতো শূণ্য হাতে কোনরকম অল্পস্বল্প খেয়ে বেঁচে আছি।
ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিলেন।ভদ্রলোকের ও মনে হয় বাবার মতো অবস্থা।টাকা ধার পাবেনা জেনেও মনকে বুঝানোর জন্য কল দিয়েছিলেন হয়তো।
মা বাবাকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ যারা করছিলেন তাদের সাথে কথা বলতে বলেছিলেন।বাবাও গিয়েছিলেন তাদের কাছে।হয়তো বলতে পারেনি লজ্জার কারণে।বাসায় চলে আসলেন খালি হাতে।বাবা ওদের কাছে চায়বে কি করে,ঘরের জানালা দিয়ে দেখছিলাম যারা ত্রাণ নিচ্ছে ওরা কেউ রিকশা চালায়,কেউ দিনমজুর।তাদের আবার ত্রাণ দিয়ে ছবিও তুলছে।
বাবার মতো কোন শিক্ষিত মহাজন ওখানে লাইনে দাঁড়ায়নি,দাড়িয়েছে খেটে খাওয়া মানুষগুলো। বাবাকে কোনদিনতো হাত পাততে হয়নি কারো কাছে। এমন অভাবের দিন সংসারে আসবে সেটাও কেউ জানতে পারেনি কোনদিন।
ওয়াশরুমের কল ছেড়ে দিয়ে অনেক কেঁদে মন হালকা করে বাবার কাছে আবার আসলাম।বাবা অসংকোচ বোধ করছেন তা বুঝেছিলাম ভালো মতো।প্রায় পাঁচ বছর আগে কেনা মোবাইলটা বদলিয়ে বাইশ হাজার টাকায় একটা দামি মোবাইল কিনব বলে খরচের টাকা খরচ না করে মাটির ব্যাংকে জমাচ্ছিলাম তিন-চার মাস ধরে।কাগজে ছোট্ট করে লিখে রেখেছিলাম নতুন মোবাইলের জন্য।বাবার চোখ পড়ল সেই কাগজের দিকে।
অন্যদিন এরকম আমার কোন প্রয়োজনের কথা জানলে আমাকে অল্প দিয়ে হলেও জিনিসটা আমাকে পাইয়ে দিতেন বাবা। কিন্তু বাবা আজ আমাকে দেওয়ার বদলে উল্টো চায়লেন।কিছু বলেনি আমাকে শুধু বলল,ব্যাংক ভেঙে দেখ,পাঁচ হাজার মতো ফেলেও আবার মাস কাটিয়ে দিতে পারব।কারো কাছে যেতে হবেনা।কিন্তু টাকা পেলাম আরো দুই হাজার কম।তাও বাবা তিন হাজার টাকা পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, আপাতত দশ-পনেরো দিন কোনরকম চলতে পারবো আমরা।বড় বিপদ থেকে বাঁচেয়েছিস মা।
বাবা চলে গেলেন বাইরে। আমি জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে চোখে ভাসিয়ে তুললাম, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে বেশি বিপদে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।না পারছে গিয়ে ত্রাণ বিতরণের লাইনে দাঁড়াতে, না পারছে উপোস থাকতে। তাই পরিবারে যার যা জমানো আছে সব নিয়ে তারা ক্রান্তির মুহূর্তটা কাটানোর চেষ্টা করছে।যদি শেষ হয়ে যায় সেই সম্বলটুকু? দেশের পরিস্থিতি যদি খারাপের দিকে যায়,তাহলে কি হবে তাদের? খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সাথে গা মিশিয়ে, লাইনে দাঁড়াবে?নাকি শরমের কারণে উপোস থেকে থেকে মরবে কি জানি।বড্ড ভয় হয় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য।এই মুহূর্তে তারা-ই সবচেয়ে বেশি অসহায়।গরিবদের জন্য যেমন আছে,তাদের জন্য কেউ আছেতো?
#মধ্যবিত্তcp